আপনি কি জানেন, কোকা-কোলা বানাতে এক সময় কোকেইন ব্যবহার করা হত?

আপনি কি জানেন, কোকা-কোলা বানাতে এক সময় কোকেইন ব্যবহার করা হত?

বিশ্ববিখ্যাত কোমল পানীয় কোকা-কোলার নাম শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে লাল-সাদা লোগো এবং ঠান্ডা, ফিজি পানীয়ের চিত্র। কিন্তু আপনি কি জানেন, এই জনপ্রিয় পানীয় এক সময় তৈরি হতো এমন একটি উপাদান দিয়ে যা আজকের দিনে সম্পূর্ণ অবৈধ এবং মারাত্মক মাদক হিসেবে পরিচিত? হ্যাঁ, এক সময় কোকা-কোলা তৈরিতে ব্যবহৃত হতো কোকেইন। এই প্রবন্ধে আমরা জানব কোকা-কোলার ইতিহাস, কীভাবে কোকেইন এর সাথে যুক্ত ছিল এবং কেন ও কখন এই উপাদানটি বাদ দেওয়া হয়।


কোকা-কোলার আবিষ্কার: একটি ওষুধ থেকে বিশ্ববিখ্যাত পানীয়

১৮৮৬ সালে আমেরিকার জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের আটলান্টা শহরে জন পেমবারটন নামে এক ফার্মাসিস্ট কোকা-কোলার আবিষ্কার করেন। তিনি মূলত একটি মেডিসিন তৈরি করতে চেয়েছিলেন যা মাথাব্যথা, ক্লান্তি এবং নার্ভের উত্তেজনা দূর করতে সাহায্য করবে। সেই চিন্তা থেকেই তৈরি হয় একটি তরল টনিক, যাতে কোকা পাতার নির্যাস এবং কোলা বাদাম থেকে প্রস্তুত করা ক্যাফেইন মেশানো ছিল।


কোকা পাতা এবং কোকেইন: সম্পর্ক কী?

কোকা পাতা মূলত দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ অঞ্চলে জন্মায়। শত শত বছর ধরে ইনকা সভ্যতার মানুষ কোকা পাতা চিবিয়ে শক্তি অর্জন করতো। কিন্তু উনবিংশ শতকের শেষ দিকে বিজ্ঞানীরা কোকা পাতা থেকে একধরনের রাসায়নিক উপাদান আলাদা করেন, যার নাম কোকেইন। শুরুতে এটি একটি ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হলেও পরবর্তীতে এটি আসক্তি তৈরি করে বলে দেখা যায় এবং ধীরে ধীরে এটি নিষিদ্ধ মাদকের তালিকায় চলে যায়।

কোকা-কোলার প্রথম রেসিপিতে কোকা পাতার নির্যাস ব্যবহৃত হতো, যার অর্থ কোকেইনও স্বল্পমাত্রায় থাকতো।


কোকা-কোলার প্রথম রেসিপি এবং কোকেইনের ভূমিকা

জন পেমবারটনের তৈরি করা কোকা-কোলার মূল রেসিপির নাম ছিল “Pemberton’s French Wine Coca”। এতে ছিল:

  • কোকা পাতা থেকে তৈরি কোকেইন

  • কোলা বাদাম থেকে প্রাপ্ত ক্যাফেইন

  • ওয়াইন (পরবর্তীতে তা বাদ দেয়া হয়)

  • বিভিন্ন ভেষজ উপাদান

এই পানীয়টি শরীরের শক্তি বৃদ্ধি করতো এবং মানসিক প্রশান্তি দিত, তাই এটি তৎকালীন সমাজে বেশ জনপ্রিয় হয়।


কোকেইন কেন বাদ দেয়া হলো?

১৮৯০-এর দশকে কোকেইনের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে চিকিৎসক ও সমাজকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়তে থাকে। তখনই আমেরিকান সরকার কোকেইনের বিক্রি ও ব্যবহার সীমিত করার উদ্যোগ নেয়।

১৯০৩ সালে কোকা-কোলা কোম্পানি তাদের রেসিপি পরিবর্তন করে কোকা পাতা থেকে কোকেইন সরিয়ে ফেলে। তবে কোকা পাতার স্বাদ ও গন্ধ ধরে রাখার জন্য 'ডিকোকেনাইজড কোকা লিফ এক্সট্র্যাক্ট' ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে কোকেইন থাকে না।


বর্তমান কোকা-কোলা: নিরাপদ এবং সুস্বাদু

আজকের কোকা-কোলা সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং এতে কোনো ধরনের কোকেইন নেই। আধুনিক রেসিপি সম্পূর্ণ গোপন হলেও জানা যায়, এতে রয়েছে:

  • কার্বনেটেড পানি

  • চিনি (বা উচ্চ ফ্রুকটোজ কর্ন সিরাপ)

  • ক্যারামেল রঙ

  • প্রাকৃতিক স্বাদ

  • ক্যাফেইন

  • ফসফরিক অ্যাসিড

এছাড়াও এটি গোপন একটি ‘৭x ফ্লেভার’ মিশ্রণ ব্যবহার করে, যা কোম্পানির ট্রেড সিক্রেট হিসেবে সংরক্ষিত।


কোকা-কোলা ও মার্কেটিং: ইতিহাস থেকে শিক্ষা

কোকা-কোলার ইতিহাসের এই অদ্ভুত অধ্যায়টি কোম্পানির জন্য একটি শিক্ষা ছিল। কোকেইনের মতো উপাদান ব্যবহার করে বাজারে প্রবেশ করলেও, সময়ের সাথে কোম্পানি নিজেদের পরিবর্তন করেছে এবং জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েছে। বর্তমানে কোকা-কোলা শুধুমাত্র একটি পানীয় নয়, এটি একটি ব্র্যান্ড, একটি সংস্কৃতি।


আপনি কী শিখলেন? (সংক্ষিপ্তসার)

  • কোকা-কোলার প্রথম দিকের রেসিপিতে কোকেইন ব্যবহার হতো।

  • কোকা পাতা থেকে পাওয়া কোকেইন একসময় মেডিসিন হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

  • ১৯০৩ সাল থেকে কোকেইন কোকা-কোলার রেসিপি থেকে বাদ দেওয়া হয়।

  • বর্তমান কোকা-কোলা সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় একটি পানীয়।


উপসংহার

কোকা-কোলার ইতিহাস শুধু একটি পানীয়ের বিবর্তন নয়, বরং এটি সমাজ, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও আইনগত পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবিও। একটি ওষুধ হিসেবে শুরু হওয়া পানীয় কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে, তা জানাটা নিঃসন্দেহে রোমাঞ্চকর। কোকেইনের মতো উপাদান এক সময় ব্যবহৃত হলেও, সময়ের বিবর্তনে কোকা-কোলা আজ একেবারেই ভিন্ন এক পরিচয়ে পরিচিত। অতীত জানলে ভবিষ্যৎ বোঝা সহজ হয়—আর কোকা-কোলার ইতিহাস তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়।


আমাদের অন্যান্য নিবন্ধ পড়ুন-

Comments